Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা

 

মুক্তিযুদ্ধে রংপুর

রাজপথে মাঝপথে রক্তের লাল রং নয় কিছু বিস্ময়কর!

সংগামী জনতার মিছিলের হুংকারে শোষকেরা কাপে থরথর।

রংপুর একটি ঐতিহাসিক স্থান । প্রাগজ্যোতিষ, কামরূপ, কামতারাজ্য ও মন্থনাকোট এর ধারাবাহিকতায় রংপুর এসেছে। মধ্যযুগের মানচিত্রে এ তথ্যসমূহ উপস্থিত। রংপু,দিস্তাং, তিস্তা ইত্যাদি নামের একটি ঐতিহাসিক নদী এবং সে নদীর বিস্তীর্ণ তীরভুমি অধ্যুষিত জনপদসমূহই প্রথমত: রংপু ও পরবর্তী পর্যায়ে রংপুরের ভৌগলিক – সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস সূচিত করে। মধ্যযুগের প্রারম্ভে সংঘটিত আলেকজান্ডার-ভারতবর্ষ যুদ্ধের (থৃষ্টপূর্ব ৩২৩) লিখিত ও চলচিত্রায়িত ইতিহাস পাওয়া যায়। সে যুদ্ধে কামরূপ থেকে হস্তিবাহিনী বা গজারোহী বাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল।সেকালে কামরূপ নামাবলীর আবরণে রংপুর তথা তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা অঞ্চলের জনপদের সামন্ত শাসকদলেরেও ছিল জাতীয় লোগো বা প্রতীক। সে প্রতীক ছিল হস্তী বা হাতির মূর্তি। কৈবর্তদের ক্ষমতা দখলের ইতিহাস আছে সন্ধাকর নদীর রামচরিতম কাব্যে, যে ইতিহাস বৃহত্তর রংপুর জনপদকেই সম্পৃক্ত করে। ১৯৭১ সালে কৈবর্তরাজ দিব্যক ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র ভীম এর বরেন্দ্র অধিকার, রাজধানীশহর গঠন, পৃথক সেনাবাহিনী ও রাজত্ব সংগঠিতকরণ, অত:পর রামপালের মারণাস্ত্রসমৃদ্ধ সংগঠিত বাহিনীর বিপক্ষে উত্তরবঙ্গবাসী আমজনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ উত্তরবঙ্গবাসী বাঙালির বীরত্বের স্বাক্ষর বহন করে। সুলতানী আমলে ঘোড়াঘাট ও পীরগঞ্জ চতরা হয়ে দাড়ায় সাময়িকভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান । পীরগঞ্জ-চতরা সীমানাভূক্ত । সুলতানী আমলের ইতিহাস পাঠে জানা যায় , ঘোড়াঘাটকেন্দ্রীক অর্ধ-শতাব্দীকাল ব্যাপী অর্ধ শতাধিক যুদ্ধ সঙঘটিত হোয়ার মধ্য দিয়েই বাঙলা মানচিত্রের আসল গড়াপেটা রুপ লাভ করেছে্ । সামরিক আধিপত্য বিস্তারকে উপলক্ষ করে যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলাফল নির্ণয় করেছে জাতিগত বিষয়াদি। যেমন, ১৪৫৯-৭৪ পর্যায়ে সুলতান রুকনউদ্দীন বরবক শাহের সময়কালে ঘোড়াঘাট ফৌজদারীর সেনাধ্যক্ষ শাহ্ ইসমাইল গাজী (রা:) এবং ১৪৭৪-১৫১৫ সময়কালের সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সময়কালে তাদের অর্জিত আধিপত্য প্রক্রিয়ায় অত্র অঞ্চল অর্থাত আধুনিক রংপুর অঞ্চলে কালক্রমে মুসলমান সংখ্যাবৃদ্ধির বিষয়টি চূড়ান্ত পরিণতি অর্জন করে। এরই সূদুরপ্রসারী ফলশ্রুতি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের সৃষ্টি। নির্মীতির অন্তরালে ঘটে গেছে ঘটনা ও দুর্ঘটনার অগণিত মিথস্ক্রিয়া এবং অনিবার্য পরিণতি।

 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ৭(সাত) মাসের মধ্যেই ততকালীন পূর্ব- বাংলা, বর্তমান বাংলাদেশের মানুষকে চরম হতাশার মধ্যে শুনতে হয়, উর্দু , এবং শুধূ উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের জনসভায় এই ঘোষণা উচ্চারণ করলেও সেই উচ্চারণের দস্যু হাওয়া ধাক্কা দেয় এসে সুদূর উত্তরবঙ্গের প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার সমান্তরাল গতিতে রংপুরেও ছিল সক্রিয় রাজনীতি এবং পাকিস্তান একনায়কতন্ত্রী যে কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমূখরতা। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে ছিলেন মণিকৃষ্ণ সেন, আমজাদ হোসেন, জিতেনদত্ত, ছয়ের উদ্দীন, ইদ্রিস লোহানী, কছিমুদ্দিন প্রমুখ। সরকারি পুলিশের নজরদারী এড়ানোর জন্য এই নেতাগণ প্রায় সব সময় আত্মগোপন থাকতেন। প্রবীণ ও অধিকতর চিহ্নিত নেতাদের অবর্তমানে নেতৃত্ব দিতেন শাহ্ আব্দুল বরী (বর্তমান ‘আহার’ ভবনের মালিক), শংকর বসু, কৃষক নেতা জমশেদ আলী চার্টি, বিনয় সেন প্রমুখ।

বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ছাত্রদের মিছিলে পাকিস্তান পুলিশ গুলি চালালে সালাম,বরকত, রফিক, জব্বার শহীদ হন।এ খবর রংপুরে আসে সন্ধ্যাবেলা। সৃষ্টি হয় উত্তেজনা। কারাইকেল কলেজ থেকে তাতক্ষণিকভাবে বিরাট মিছিল বের হয়। মিছিলে হামলা করে পুলিশ। পুলিশের গুলিতে আহত হয় ৩(তিন) জন। পুলিশের দমন পীড়ন এড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় খন্ড মিছিল অব্যাহত থাকে। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে। ছাত্র আন্দোলন ক্রমশ: বেগবান হয়। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মতিউর রহমান (পরবর্তীতে মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ), নুরুল ইসলাম (পরবর্তীতে অধ্যাপক), আব্দুস সোবহান (গাইবান্ধা), কাজী আব্দুল হালীমখন্দকার আজিজার রহমান (গাইবান্ধা), সুফী মোতাহার হোসেন, মকসুদ হোসেন (মুন্সিপাড়া রংপুর) প্রমুখ।

১৯৫৪ সালের ২৯ মে পাকিস্তানে ৯২ (ক) ধারা জারির পর শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক গৃহবন্দি হন, শেখ মুজিবসহ পাচ- ছয় হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ মে ১৯৫৪ তারিখে পুলিশ গ্রেফতার করে রংপুরের যুক্তফ্রন্ট কর্মী কাজী মোহাম্মদ এহিয়া, শিবনে মুখার্জী, নূরুল ইসলাম (পরবর্তীতে অধ্যাপক), সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম, আজিজুল হক এডভোকেট, ভিকু চৌধুরী , ধীরেন ভট্টাচর্য, দারাজ উদ্দীন মন্ডলকে। একই সময়ে গ্রেফতার হন গাইবান্ধার মতিয়ার রহমান, মিঠাপুকুরের আব্দুল জলিল প্রধান, নীলফামারির জমশেদ আলী, শফিয়ার রহমান প্রমুখ।

পঞ্চাশের দশকে রংপুরে ‘ছেড়া তার’ নামে একটি নাটক রাজনৈতিক মর্যাদা অর্জন করে। রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত তুলশী লাহিড়ীর এই নাটকটিতে প্রভাবশালী কর্তৃক গরীব মানুষকে শোষণের আলেখ্য রূপায়িত হয়। কাজী মুহাম্মদ এহিয়া এতে মূল চরিত্রে অভিনয় করতেন। উদ্দেশ্য ছিল, শোষণ বঞ্চনা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে সচেতন করে তোলে। পাকিস্তান পুলিশ এ নাটকের মঞ্চায়নে বাধার সৃষ্টি করেছিল। ষাটের দশকের রাজনীতিতে আরো্ ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করেছিল জহির রায়হানের সিনেমা ‘জীবন থেকে নেয়া’।

’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা প্রাপ্তিতে সারাদেশের মতো রংপুরের মানুষ উদ্বেলিত হলো। ইয়াহিয়া থান একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আহবান করলেন। কিন্ত ভুট্টোর ষড়যন্ত্রে তা আবার স্থগিত হয়ে গেলো। দেশবাসী অধির আগ্রহে আশা করছিলো বাঙালির ম্যান্ডেট নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর ক্ষমতায় যাচ্ছেন। ইয়াহিয়া খানের কুট কৌশল বুঝে ১ মার্চ সংসদীয় দলের বৈঠক ডেকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের সিদ্ধান্তের ঘৃণা ভরে প্রত্যাথান করলেন বঙ্গবন্ধু এবং ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা দেশে হরতালের কর্মসূচী ঘোষণা করলেন: পরবর্তী ঘোষণা ৭ মার্চ রেসকোর্সের মাঠে দেবেন বলে জানিয়ে দিলেন। রপুরে ২ মার্চ ১১ দফা আন্দোলনের নেতা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আব্দুর রউফ অনেক রাত অবধি সভা করলেন পাঙ্গা হাউসের ছাদে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রংপুর জেলা ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি রফিকুল ইসলাম গোলাপ, সাধারণ সম্পাদক মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, ছাত্রনেতা হারেস উদ্দিন সরকার, অলক সরকার, ইলিয়াস আহমেদ, আবুল মনসুর আহমেদ, মাহবুবুল বারী, মুখতার ইলাহী, জিয়াউল হক সেবু, জায়েদুল, নুরুল হাসানসহ অন্যান্য নেতা- কর্মীবৃন্দ।

রংপুর জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম নেতা সিদ্দিক হোসেন এমসিএ, শেখ আমজাদ হোসেন, এ্যাডভোকেট আব্দুল গণি, শাহ্ আব্দুর রাজ্জাক এমসিএ, হামিদুজ্জাম্ন এমসিএ, গাজী রহমান এমসিএ, তৈয়বুর রহমান, আবুল হোসেন, মীর আনিছুল হক পেয়ারা প্রমূখ নেতৃবৃন্দ এ অঞ্চলের  মানুষকে প্রতিরোধ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য কর্মী বাহিনী নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লেন।

১১ দফা কর্মসূচী আন্দোলনের ছাত্রনেতা আব্দুর রউফ রংপুর প্রেস ক্লাবে জানিয়ে ছিলেন, সংগ্রাম ছাড়া সামনে আর কোন পথ নেই।পরদিন ৩ মার্চ সারা দেশের মতো রংপুরেও হরতাল পালিত হয়। হরতালের জন্য কোন পিকেটিং এর প্রয়োজন হয়নি। স্বত:স্ফুর্ত মানুষ হরতাল করে। রংপুরের রাজনীতির ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। কাচারি বাজার হতে ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে ছোট একটি মিছিল শুরু হয় মূল শহর অভিমূথে। পথে সর্বস্তরের মানুষ মিছিলে অংশগ্রহণ করতে থাকে। ক্রমানয়ে মিছিলের বিশালতা বাড়তে থাকে। মিছিলটি ছিল জঙ্গি কিন্ত সুশৃঙ্খল । মিছিলে গণনবিদারী শ্লোগান চলছে।‘তোমার আমার ঠিকানা – পদ্মা, মেঘনা,যমুনা’। ‘ তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’।‘ ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। মিছিল প্রেসক্লাব চত্বরে এলে অসংথ্য মানুষ হাততালি দিয়ে স্বাগত জানায়।সে সময়ের এমসিএ সিদ্দিক হোসেন সাথী – কর্মী নিয়ে মিছিলে যোগ দেন। সবারই এক লক্ষ্য স্বাধীনতা। মিছিলের অগ্রভাগে সিদ্দিক হোসেন এমসিএ , ডা: সোলায়মান মন্ডল এমএনএ, ছাত্রনেতা রফিকুল ইসলাম গোলাপ, অলক সরকার, মাহবুবুল বারী, খন্দকার গোলাম মোস্তফা বাটুল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম(প্রয়াত), হারেস উদ্দিন সরকার, মমতাজ জাকির আহমেদ সাবু, খন্দকার মুকতার ইলাহী, জিয়াউল হক সেবু, নূরুল রসুল চৌধুরী, ইলিয়াস আহমদ, হালিম খান, তবিবুর রহমান, গোলাম কিবরিয়া, আব্দুল মান্নান (খলিফা), নূরুল হাসান, আবুল মনছুর আহমেদ, জায়েদুল, টুলু লুলু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

কথা ছিল, তেতুলতলা থেকে মিছিল ফিরে আসবে আবার শহরে। কিন্তু তেতুলতলায় কারমাইকেল কলেজের ছাত্র নেতৃবৃন্দের এবং আলমনগর এলাকার আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগের নেতা কর্মীদের চাপের মুখে মিঠিল এগিয়ে চললো আলমনগর স্টেশন অভিমূখে।  মিছিলের অগ্রভাগ যখন খাদ্য গুদামের কাছে পৌছেছে ঠিক সে সময়ে গুলি বর্ষিত হলো অবাঙালি সরফরাজ খানের বাড়ি থেকে। গুলিতে আহত হয়েছে এক কিশোর। নাম তার শংকু সমজদার, বাড়ি গুপ্তপাড়ায়। বয়ষ আনুমানিক ১২ বছর। আহত শংকুকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো মিছিলে অংশগ্রহণকারী মোসলেম উদ্দিন (পরবর্তীতে পৌর কমিশনার) । কিন্ত হাসপাতালে পৌছার আগেই শংকু মারা গেছে। শংকু মারা যাবার খবরে উত্তেজিত হলো জনতা। এক পর্যায়ে সারা শহরে অবাঙালিদের দোকানে ভাংচুর অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। যে বাড়ি থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে তা আক্রমণের চেষ্টাকালে ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা বাধা দেয়। বিক্ষুদ্ধ জনতাকে শান্ত করার জন্য

এমএনএ ড়া: সোলায়মান মন্ডল জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। যে কো্ন মূল্যে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান। সারা শহর তথন বিক্ষুদ্ধ। খন্ড খন্ড মিছিল চলছে। ইতোমধ্যে অবাঙালিদের গুলিতে আরো দুজন প্রাণ হারালো। এরা হলেন রংপুর কলেজ ছাত্র আবুল কালাম আজাদ, বাড়ি মিঠাপুকুর। অপরজন সরকারী চাকুরে ওমর আলী। ওমর আলী ছুরিকাঘাতে মারা যান দেওয়ানবাড়ি রোডের জেনারেল বুট হাউজের সামনে। আবুল কালাম আজাদ প্রাণ হারান বাটার গলির মুখে একচেঞ্জের সামনে। মিছিলে সেদিন দুজন ছাত্র আহত হয়েছিল। একজন শরিফুল আলম ওরফে মকবুল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় বিনা চিকিতসায় একমাস পর হাসপাতালে প্রাণ হারান। অপরজন মোহাম্মদ আলী, রংপুর কলেজের ছাত্র সংসদের ছাত্র মিলনায়তন সম্পাদক, পায়ে গুলি বিদ্ধ হয়েছিল। সে সময়ে রংপুরের ডেপুটি কমিশনার সৈয়দ শামীম আহসান ব্যক্তিগত উদ্দোগ নিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্ত ব্যর্থ হয়ে বেলা ২.৩০মিনিটে সন্ধ্যা আইন জারি করেন। তিন জনের লাশ দেথে এসে পরবর্তী কর্মসূচী নিয়ে আলোচনায় বসার জন্য আওয়ামী লীগ, ছাত্র লীগ নের্তৃবৃন্দ ডিসির বাসভবনে পৌছেন বিকেল ৪ টায় । মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান রংপুরের মানুষের এ ত্যাগের কথা জলদগম্ভীর কন্ঠে উচ্চারণ করেছেন।

১৭ মার্চ ৭১ রংপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম গোলাপ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রেরিত স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকার নমুনাসহ স্বাধীনতার ইশতেহার গ্রহণ করেন। ২৩ মার্চ জেলা প্রশাসকের বাসভবনে এবং ইলিয়াস আহমেদ জেলা প্রশাসক অফিসের ছাদে স্বাধীন বাংলা পতাকা উত্তোলন করেন। একই দিনে নবাবগঞ্জ বাজারে স্বাধীন বাংলা পতাকা উত্তোলন করেন ন্যাপ (ভাসানী) নেতা মাহফুজ আলী(জররেজ)। নবাবগঞ্জ বাজারের পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মরহুম মো: আজমল, মোজাফ্ফর প্রধান, সেলিম চৌধুরী, শাহ্ তবিবর রহমান, শেখ শাহী, মোজাহারুল ইসলাম লুলু, আবু জাফর মুকুল, কাজী আহমেদ এহিয়া এবং আরো অনেক। পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে নেতা মাহফুজ আলী (জররেজ) বীরত্বব্যঞ্জক স্বরে বলেন, ‘আজ আমরা স্বাধীন, দেশ স্বাধীন করব নয়তো মরবো’। সভায় সভাপতিত্ব করেন কাজী মোহাম্মদ এহিয়া। তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি দিবচক্ষ্যে দেখতে পাচ্ছি, বাংলার মানুষ এ দেশকে অল্পদিনের মধ্যে স্বাধীন করবে”। উল্লেখ্য, ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এর বাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

২৪ মার্চ ৭১ রংপুরে একসাথে ঘটে দুটি ঘটনা। ঐদিন কার্ফ্যু ভঙ্গ করার দায়ে পাকবাহিনী ইয়াকুব মাহফুজ আলী জররেজকে বেত্রাঘাত করে এবং ন্যাপ কর্মী রফিককে মেরে পায়ের হাড় ভেঙ্গে দেয়। জনগণ এই অত্যাচারের প্রতিবাদে জেলা প্রশাসকের বাংলো ঘেড়াও করে। ওদিকে মুরগি ও ডিমের খোজে পাকবাহিনীর একটি জীপ দামোদড়পুর হাটে গেলে শাহেদ আলী, রফিকুল আলম বাদশা, আব্দুস ছালাম, রফিকসহ আরো তিন-চার জন বাঙ্গালী যুবক তাদের ঘিরে ফেলে। উদ্দেশ্য, পাকবাহিনীকে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া । ৭ই মার্চ এর ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “ওদের ভাতে মারবো পানিতে মারবো”। শাহেদ আলী লাফ দিয়ে গাড়ীর বনেটে উঠে একটানে এল.এম.জি. ছিনিয়ে নেয় দাড়িয়ে পাকিস্তানি সেনার কাছ থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে লে. আব্বাসী। এ সুযোগে শাহেদ আলী খাপ্পর দিয়ে (বল্রমের মতো), আঘাত করে আব্বাসীকে। ক্যাপ্টন আব্বসী লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। রফিক, ছালাম, রফিকুল আলম বাদশা তাতক্ষনিকভাবে তাদের হাতে থাকা চাপাতি, কুড়াল, কোদাল দিয়ে আঘাত করতে থাকে অপর তিনজন সেনাকে।

এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, ছিল তখনকার ঐতিহাসেরই ধারাবাহিকতায় একটা অনিবার্য  ঘটনা। বলা উচিত, মুক্তিযোদ্ধেরই সুচনা ঐ ঘটনায় বাঙালি জনতা পাকসেনাদের সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নেয় এবং জীপটি পুড়িয়ে ফেলে। জনতার আক্রমণে আহত পাকসেনাদের রংপুর সদর হাসপাতালে আনা হয়, বিদ্রোহী জনতা হাসপাতালে  ওদের চিকিতসার বিরোধীতা করলে পাকসেনারা জনতার আক্রমণের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে গুলি ছুড়ে। এখানে এই ঘটনার পাকসেনাদের গুলিতে পৌরবাজারের সামনে রাজ্জাক নিহত হয়। হত্যাকান্ডে ঘটনায় জনতার মাঝে নতুন করে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। শহীদ রাজ্জাকের সমাধি আছে হনুমন তলা কাজী নজরুল ইসলাম রোডে।

ওদিকে ২৫ মার্চের কাল রাতে ঢাকার রাজারবাগ ও পিলখানা পুলিশ স্টেশনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবরের গ্রেফতারের খবরে গোটা রংপুরের মানুষ জঙ্গি প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠে। ততকালীন রংপুর জেলার রংপুর সদর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা মহকুমার প্রত্যেক থানায় বিক্ষুদ্ধ জনতা সবখানে রেললাইন তুলে ফেলে। পুল, কালভার্ট ভেঙ্গে দেয়। যোগাযোগের সময় রাস্তা কেটে দিয়ে রাস্তার উপর বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড রচনা করেন।

 

 

তিস্তা ব্রীজের (কাউনিয়া পয়েন্ট) যুদ্ধঃ ২৭ মার্চ ১৯৭১

২৩তম ব্রিগেড রংপুর সেনানিবাসের মেজর এজাজ মোস্তফা ছিলেন অবাঙালী। ২৭ মার্চ ৭১, পাকিস্তানিরা তাকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠায় তিস্তা ব্রীজ দখল করার জন্য। মেজর এজাজ মোস্তফা রংপুর শহর থেকে অবাঙালি যুবকদের একটি দল নিয়ে কাউনিয়ায় যান। কাউনিয়ার ওসিকে সাথে নিয়ে তা’রা তিস্তা নদীর দক্ষিণপাড়ে রেকি করতে থাকেন। তাদের অনুমান ছিল যে, গুরুত্বপূর্ণ তিস্তা রেলসেতুর অপর পাড়ে বাঙালি মুক্তিসেনা ও মুক্তিপাগল জনতা অপেক্ষায় আছে। পাকিস্তানদের অনুমান ভুল ছিল না, ভুল ছিল বাঙালিদের সমর্থক সম্পর্কে ধারণা। পাকিস্তান সেনানিবাস থেকে ২৬ মার্চ পালিয়ে কুড়িগ্রামে  চলে যাওয়া ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ইতোমধ্যেই সেখানে আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগসহ অগ্রসর ছাত্র সমাজ এবং কলেজ অধ্যাপক, রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দকে সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধ হেডকোয়াটার গড়ে তুলছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক নেতৃবৃন্দ, ছাত্র নের্তৃবৃন্দকে নিয়ে হাইকমান্ড গঠন করেছেন। নওয়াজেশ এসব সাংগঠনিক কাজ সম্পন্ন করেছেন ইথারের গতিতে। অত:পর এই চৌকষ বাঙালি সেনাকর্মকর্তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তার বাহিনী পাঠিয়ে দিয়েছেন তিস্তা রেলসেতুতে। ইপিআর জোয়ানরা সেতুর উপর ওত পেতে ছিলো। পাকিস্তানি সেনারা তিস্তার পশ্চিমপাড়ে এক শ’গজ নিশানার মধ্যে আসা মাত্র হাবিলদার ওহাব গুলি ছোড়েন। অব্যর্থ গুলি পাকিস্তানি মেজর এজাজ মোস্তফার বুক ফুটো করে বেরিয়ে যায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তান পক্ষের ১৫ জন সেপাহী ও্র কাউনিয়া খানার ওসি মৃর্ত্যু বরণ করেন। অবশিষ্টরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে এটা ছিল একেবারেই দিককার সম্মুখযুদ্ধ, এবং এ যুদ্ধে বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেন।

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ

 

এদিকে ২৮ মার্চ ৭১ রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের কর্মসূচী হাতে নেয় রংপুরের জাগ্রত সাহসী জনতা।রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরী করেন ততকালীন আইন পরিষদের সদস্য আওয়ামীলীগ নেতা জনাব সিদ্দিক হোসেন, নিসবেতগঞ্জের আওয়ামীলীগ নেতা শেখ আমজাদ হোসেন, এ্যাডভোকেট গণিসহ অনেকেই। অভিযান সফল করার জন্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট প্রচারণা শুরু করেন। দুর্ভাগ্য রংপুর বাসীর রংপুর ক্যান্টমেন্ট আক্রমণের খবর যেভাবেই হোক পৌছে যায় পাকিস্তানি সেনা কর্মাদের কাছে। ২৮ মার্চের ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাওয়ের সংগঠক জনাব শেখ আমজাদ হোসেন আমাকে জানিয়েছেন, ২৭ মার্চ রাতে রংপুর নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়ায় জনৈক উকিলের বাড়ীতে আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগের একিট গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।  সেই বৈঠকে ঘাপটি মেরে বসে থাকা জনৈক পাকিস্তানি চর সমস্ত খবর ফাস করে দেয় পাকিস্তানিদের কাছে।

এ পর্যায়ে ঢাকা সেনানিবাস হেডকোয়াটার থেকে নির্দেশ আসে বাঙালি সৈন্য ও বাঙালি ই.পি.আর জোয়ানদের গ্রেফতার নিরস্ত্র করার। আরো নির্দেশ আসে রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের। ২৭ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা রংপুর ই.পি.আর ক্যাম্পে হানা দিয়ে বাঙালি জোয়ানদের গ্রেফতার করে এবং তাদের সমস্ত অস্ত্র ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। ওরা ক্যান্টনমেন্টের ভিতর ট্যাংক বাহিনীর বাঙালি সেনাদের গ্রেফতার করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্র্রেফতারের জন্য বিশাল গাড়ির বহর নিয়ে অস্ত্র উচিয়ে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে তল্লাশী চলে।

 

 

রংপুর শহরের মহান শহীদদের তালিকা

 

এ ওয়াই, মাহফুজ আলী জররেজ মিঞা:মুন্সিপাড়া, রংপুর। ৪ এপ্রিল দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার কর্তৃক নিহত।

 মুখতার এলাহী:ধাপ, রংপুর। রংপুর জেলা ছাত্রলীগের নেতা। ’৭১ এর পূর্বে কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। ছাত্র সমাজের প্রাণপ্রিয় এই মেধাবী ছাত্রনেতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রংপুরে কয়েকটি সফল অপারেশন করেন। নভেম্বর মাসে লালমনিরহাটের বড়বাড়ীতে শহীদ হন।

 

মিলি চৌধুরী: পিতা কাজী মো: ইলিয়াস, মুন্সিপাড়া, রংপুর। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে রংপুর আসার পথে টাঙ্গাইলের পাকুল্লা গ্রামে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত হন।

শাহ্ আব্দুল মজিদ: পিতা: জনাব ইউনুস, কেরানীপাড়া, রংপুর। ৭১ এ রাজশাহীর পুলিশ প্রশাসক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ৩১ মার্চ সন্ধ্যায় পাকসেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তার আর খোজ পাওয়া যায়নি।

সহিদার রহমান রাফাত: বয়স:২৪ বছর, পিতা মো: সমসের আলী, মিস্ত্রিপাড়া, মুন্সিপাড়া, রংপুর সদর। ১৯৭১ সালের ৭ ই মে শুক্রবার বেলা ১ টার সময় লাহিরিরহাট পুকুর পাড়ে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আরো ৩২ জনসহ নিহত হন।

চাদ মিঞা: বয়স : ২৪ বছর, পিতা মোহাম্মদ আলী, মিস্ত্রিপাড়া, মুন্সিপাড়া, রংপুর। ১৯৭১ সালের  ২৪ আগষ্ট রংপুর লক্ষী সিনেমা হলের সামনে থেকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে যায় এবং সেদিন থেকে নিখোজ হন।

সেকেন্দার: বয়স: ২৭ বছর, পিতা আব্দুল মান্নান, কেরানীপাড়া, রংপুর। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি বাসায় এসেছিলেন তার মাকে দেখতেন। এ সময়ে রাজাকার বাহিনী চরবা খবর দিলেন পাক হানাদার বাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যান। সেদিন থেকে তিনি নিখোজ হন।

মো: সবদার আলী: বয়স: ২২ বছর, রামপুর, রংপুর। ১৯৭১ সালে ২৬ এপ্রিল থেকে নিখোজ হন।

ঘুটু মিঞা: মুন্সীপাড়া, রংপুর। (পরিচয় অজ্ঞাত)

হেছাব আলী: মুন্সীপাড়া, রংপুর। (পরিচয় অজ্ঞাত)

মোছা: রাবেয়া খাতুন: স্বামী মৃত- এস এম বারী, কেরানীপাড়া, রংপুর। ১৯৭১ সালে ৯ ডিসেম্বর আনুমানিক বিকাল ৪ টার সময় বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত গুলিতে নিহত হন। মিত্রবাহিনীর বিমান যখন তার বাড়ির উপর দিয়ে যাচ্ছিল তথন তার প্রতিবেশী রাজাকার কমান্ডার জবান মিঞার বাড়ী থেকে বিমানকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া হয়। গুলি ছোড়ার পর বিমান থেকে ব্রাশফায়ার করা হয় এবং এর আঘাতে রাবেয়া খাতুন নিহত হয়।

জনাব কাচু: ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ এর মাঝামাঝি সময় পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিশবেতগঞ্জের নিকট নিহত হন।

দুর্গাদাস অধিকারী:  ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত হন।

উত্তম কুমার: পিতা দুর্গাদাস অধিকারী, ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত ।

দুলাল: পিতা বছির উদ্দিন, ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত ।

মো: মহরম: (বছির উদ্দিনের জামাই), ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত ।

রফিক আলী : পিতা আলী আহমেদ, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত ।

ক্ষিতীশ হাওলাদার : ধাপ ব্যাপটিষ্ট চার্চ, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত

গোলাপ: ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, রংপুর। ৪ এপ্রিল ৭১ দখিগঞ্জ শ্মশানে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত ।

পূর্ণচন্দ্র সরকার: লিচু বাগান, রংপুর। অশিতিপুর বৃদ্ধ এই আইনজীবিকে ৭১ সালে ২৬ মে গভীর রাতে পাকহানাদাররা ধরে নিয়ে যায় এবং ঘাঘট নদীর ধারে শনকামারীতে মেরে ফেলে।

রনি রহমান: বয়স: ৩২ বছর, পালপাড়া, রংপুর। ২৭ মার্চ কুষ্টিয়া সেক্টরে পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হন।মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন কুষ্টিয়ার প্রথম শহীদ।

উমর আলী: পিতা আতোয়ার আলী, মুলাটোল,রংপুর। ৩ রা মার্চ ১৯৭১ শহীদ অঙ্গনের পাশে(জাহাজ কোম্পানীর মোড়) নিহত হন।

শংকর লাল বণিক: পিতা রাধাবল্লব বণিক, বয়স : ২৭ বছর, লিচুবাগান, রংপুর। ২৬ মে ৭১ সালে রাত ১১ টা ৩০ মিনিটে নিজ বাড়ী থেকে পাক হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় ধরে নিয়ে যায়।

শৈলেন চন্দ্র দত্ত: পিতা মৃত- ভোলানাথ দত্ত, বয়স: ১৫ বছর। ২৬ মে ১৯৭১ সোমবার রাত ১১ টা ৪৫ মিনিটে বাড়ীতে ধরার পর তার ঘাড় ভেঙ্গে দিয়ে জীপের পিছনে রশি দিয়ে নজিরহাটের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারপর থেকে তিনি নিখোজ হন।

সন্তেষ মিত্র: বষয়: ৪৫ বছর, পেশা: চাউলের ব্যবসায়ী, গোমস্তাপাড়া, রংপুর জাতীয় পতাকা নিজ বাড়ীতে তোলার সময় সাধারণ পোশাকধারী পাক হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। কোমরে দড়ি বেধে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি তখন থেকে নিখোজ হন।

বৈদ্যনাথ রায়: বষস: ৩৭ বছর, পালপাড়া, রংপুর। পেশা- জর্জকোর্টের চাকুরীজীবি। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে।

নজরুল ইসলাম ঢালী: বষয়: ১৯ বছর, পালপাড়া, রংপুর। সাহিত্য অনুরাগী, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার ও সাংবাদিক।মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে সংবাদ সরবরাহ করতেন। ১৩ আগষ্ট ৭১ রাতে লাহিড়ীর হাটের ভাটার নিকট নিহত হন। নিহত হওয়ার পূর্বে ১৫/১৬ দিন ধরে পি.টি.আই- এর একটি নির্জন কক্ষে আটকে রেখে তার উপর অমানবিক নির্যাতন করা হয়।

ভিখু চৌধুরী: পিতা মৃত: মজীর উদ্দিন চৌধুরী, সেনপাড়া, রংপুর। ১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকা থেকে রংপুর আসার পথে টাঙ্গাইলের পাকুল্লা গ্রামে সন্ত্রীক পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নৃশংসভাবে নিহত হন।

অশ্বিনী কুমার ঘোষ: বষস: ৪৫ বছর, পিতা মৃত-ফটিক চন্দ্র ঘোষ, গোমস্তাপাড়া, রংপুর। ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল রংপুর শহর ত্যাগ করার সময় পুরাতন রেডিও সেন্টারের নিকটে পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত হন এবং নির্যাতন করে জাফরগঞ্জে হত্যা করে।

রেনুবালা ঘোষ: বষস: ৪৫ বছর, পিতা: রাখাল চন্দ্র ঘোষ, গোমস্তপাড়া,রংপুর। ১৯৭১ সালে ১৪ এপ্রিল অশ্বিনী কুমার ঘোষের সাথে শহর ত্যাগ করার সময় পুরাতন রেডিও সেন্টারে নিকট পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত হন এবং অমানবিক নির্যাতন করে জাফরগঞ্জে পুলের নিচে হত্যা করে।

রবি: বষয়: ১৮ বছর, গোমস্তাপাড়া, রংপুর। ১৯৭১ সালে ১৪ এপ্রিল রংপুর শহর ত্যাগ করার সময় পুরাতন রেডিও সেন্টারে নিকট পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত হন এবং অমানবিক নির্যাতন করে জাফরগঞ্জে পুলের নিচে হত্যা করে।

আবুল হোসেন(শাহজাহান): গোমস্তাপাড়া,রংপুর। ২৪ জুন ৭১ ক্যান্টনমেন্টের নিকট পাকসেনা কর্তৃক ধৃত এবং পরে রাত্রিতে নিহত হন।

মুক্তিযোদ্ধা মোবারক হোসেন: পিতা মৃত: আব্দুল কাদের, শালবন, রংপুর। মুক্তিযোদ্ধা মোবারক, হলদিবাড়ী চিলাহাটিতে ২৬ আগষ্ট পাক বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হন।সেন্ট্রাল রোডের নাম তার নামে শহীদ মোবারক হোসেন শরণী করা হয়েছে। কিন্তু এ নামকরণ বাস্তবায়নে কোনো প্রায়োগিক ততপরতা নেই। আমরা গান গেয়ে থাকি:

“ এক সাগর রক্তের বিনিময়ে.......................

আমরা কোনো দিন ভুলবো না ......................

তোমাদের এই ঝণ শোধ হবে না;

না! না! শোধ হবে না।‌

আব্দুর রাজ্জাক : পিতা আব্দুর জব্বার, ২৪ মার্চ রাতে ২ নং ট্রাফিকের সামনে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত।

আব্দুল হালিম: পিতা মৃত আকবর আলী, জুম্মাপাড়া, রংপুর। (পরিচয় অজ্ঞাত)

আব্দুল মান্নান: পিতা মৃত: মতিয়ার রহমান বসুনিয়া, হনুমানতলা,রংপুর।(পরিচয় অজ্ঞাত)

পাখি মৈত্র: গুপ্তপাড়া, রংপুর। প্রখ্যাত আইনজীবি। ২৫ মে মধ্যরাতে পাকবাহিনী তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।

মাজাহার হোসেন: গুপ্তপাড়া, রংপুর। ই.পি. আর বাহিনীর নায়েক। ওয়ালেস বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বাঙ্গালী । বাঙালিদের পক্ষে মত পোষনের জন্যই তাকে ৭ এপ্রিল রংপুর ই.পি.আর ক্যাপ্টেন থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করার পর পাক আর্মীরা ১৭ এপ্রিল মাহিগঞ্জের কলাবাগানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হলে তিনি প্রতিবাদ জানান ততক্ষনাত তাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। তার সাথে আরো নিহত ব্যক্তিদের নাম জানা যায়নি।

মোজাম্মেল হোসেন ও নাসিম: গুপ্তপাড়ায় এরা দুজন পিতা ও পুত্র। জুন-জুলাই মাসের দিকে গুপ্তপাড়ার বাসা থেকে রংপুর টাউনহল পাঞ্জাবী পুলিশরা তাকে বলেন, “লাড়কী লে- আও তব ছোড় দেংগে ‍‌” স্বামী এবং পুত্রকে বাচানোর চেষ্টায় হাতে টাকা নিয়ে মিসেস মোজাম্মেল রংপুর শহরের বিভিন্ন জায়গায় মেয়ে খুজতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অবশেষে মোজাম্মেল হক এবং নাসিমকে নিসঙ্গভাবে হত্যা করা হয়।

রফিকুল ইসলাম: রংপুর কলেজের ছাত্র ছিলেন, তার বাড়ী পাটগ্রামে। গুপ্তপাড়ায় থাকতেন। অত্যন্ত সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করেছেন।রংপুরের অদূরে পাক আর্মী ক্যাম্পে আক্রমণ চালাতে গিয়ে উভয় পক্ষে গুলি বিনিময় হয়। একটু অসাবধানতার কারণে সাব মেশিনগানের গুলিতে নিহত হন। গুলি বদ্ধ হওয়ার সময় তার হাতে ছিল এস,এল, আর।

আলী মিয়া ও চান মিয়া: গুপ্তপাড়া, রংপুর, বিহারীদের নিকট খবর শুনে পাঞ্জাব পুলিশরা জুলাই মাসের দিকে রাত প্রায় ১ টার সময় গুপ্তপাড়াস্থ আলী মিয়ার মুদি দোকানে মামলা চালিয়ে দোকান থেকে আলী মিয়াকে এবং দোকানের চৌকির নিচে ভয়ে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তার দোকানের কর্মচারী চান মিয়াকে গ্রেফতার করে এবং টাউন হল ক্যাম্পে তাদেরকে ৭ দিন নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।

শংকু সমজদার ও শরিফুল আলম(মকবুল): রংপুরের প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে মিছিল হয় ৩ মার্চ সকাল ১০টার দিকে। সেই মিছিলে রংপুরে সংগ্রামী জনতা অংশ নেয়। আলমনগর স্টেশনমোড় বর্তমান দরদী সিনেমা হলের সন্নিকটে ১২ বছরের কিশোর, শংকু, উর্দুতে লেখা সাইন বোর্ড নামিয়ে ফেলতে গেলে একজন অবাঙালি গুলি চালায়। এই গুলিতে শঙ্কু ততক্ষনাত নিহত এবং শরিফুল আলম(মকবুল) আহত হন।

*আব্দুল আজিজ, পীরপুর, আলমনগর। *বাসু মিঞা- আলমনগর।

* কুমুদ বন্ধু সরকার- রবার্টসনগঞ্জ। * জিতেন সরকার – তাজহাটভ।

* শান্তপাড়া- বাবুপাড়া, আলমনগর। * গোলাম মর্তুজা- বাবুপাড়া,রিফিউজী কলনী।

* পান্নার ভাই-               * হোসেন –ওয়েল মিলের একজন শ্রমিক।

* শেখ ফরিদ- পিতা মৃত: আবু তাহের, নূরপুর।* দবির মিঞা- পিতা: মেরাজ উদ্দিন, নুরপুর।

(৭ মে ১৯৭১ নিহত হন)               (৭ মে ১৯৭১ নিহত হন)।

*আব্দুছছালাম- কলোনী, আলমনগর।     * মেহেরআলীকলোনী, আলমনগর।

* মর্তূজা মিঞা – সরকার কর্মচারী, আলমনগর   *শান্তি চাকী- বাবুপাড়া।

* সতেন্দ্রনাথ মালী- তাজহাট(সরকারী কর্মচারী কালেক্টরেট) * গেদু মিঞা- পীরপুর, আলমনগর।

* আব্দুল জলিল মিঞা- বাবুপাড়া। * আক্কাস আলী- তাজহাট।

*কাশেম মিয়া- তাজহাট ।

(উল্লিখিত * চিহ্নিত শহীদের পরিচয় অজ্ঞাত)

 

মুক্তিযোদ্ধা অনুসন্ধান করতে ভিসিট করুন
http://molwa.gov.bd/fighter_search.php

 

 

মুক্তিযুদ্ধে রংপুর জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধে দিনাজপুর জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধে নীলফামারী জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রাম জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধে ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধে লালমনিরহাট জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধে গাইবান্ধা জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

মুক্তিযুদ্ধে পঞ্চগড় জেলার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন

 

 

ধন্যবাদান্তে - আইসিটি শাখা, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, রংপুর বিভাগ, রংপুর